আমি নোয়াখালি থেকে বলছি...
নোয়াখালি বাংলাদেশের এক বৃহত্ জেলা। সেখানের ভাষা যেমন শক্ত, মানুষের মন তেমনি নরম। আমার বাবা নোয়াখালির মানুষ, এবং সেই সুত্রে আমিও। আমার বাড়িতে মহা বর্ণবিদ্দেষ। আমার মা বাংলাদেশের আরেকটি জেলা, সিলেটের মানুষ, যদিও মার জন্ম এবং বড় হওয়া ত্রিপুরার কৈলাশহরে। মা সিলেটি এবং বাবা নোয়াখালি; তাই আমার এক বন্ধু ছোটবেলা আমাকে বলতো আমি নাকি ‘নোয়াসিলেখালিটি’। হি হি হি। সে যাই হোক। আমি দুটো ভাষাই মোটামুটি জানি। আজকের এই গল্প দুটি নোয়াখালি নিয়ে। সিলেটি নিয়ে পরে মাতামাতি করা যাবে।
অনেক দিন আগে এটা পড়েছিলাম, খুব সম্ভবত আজকাল পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। ঘটনাটা ঘটেছিল একজন লেখকের সাথে। উনার নামটাতো আজ আর মনে নেই। গল্পটা যতটুকু মনে আছে, বলছি। তিনি একবার গিয়ে পৌছলেন নোয়াখালির কোনো এক গ্রামে। দুপুর বেলা বাস থেকে নেমেছেন, খুব পরিস্রান্ত। নেমেই দেখলেন বাস স্ট্যান্ডের পাশে একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে উনার বেশ লাগলো।
“তোমার নাম কি?” উনি এগিয়ে গিয়ে জিগেস করলেন।
“আঁর নাঁ নি? আঁর নাঁ হোঁতিয়াঁ।” বলেই মেয়েটি এক দৌড়ে হারিয়ে গেল।
লেখক হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কিছুতেই বোধগম্য হোল না যে মেয়েটি কি বললো। তার পর অনেকদিন তিনি ছিলেন ওই গ্রামে, কিন্তু ওই মেয়েটিকে কিছুতেই আর খুঁজে পেলেন না। কাউকে যে জিগেস করবেন, সেই ক্ষমতাও তো নেই; যা উচ্চারণ সেই মেয়েটি করেছিল, তিনি তা পারবেন কেন? অবশ্য নোয়াখালি ছাড়ার কিছুদিন আগে তিনি নিজের সেই প্রশ্নের জবাব পেয়েছিলেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে সেই ছোট্ট মেয়েটি সেদিন তার প্রশ্নের জবাবে কি বলেছিল। সেটা অনেকটা এইরকম –
“আমার নাম নাকি? আমার নাম প্রতীমা।”
হা হা হা। ভাল না? হ্যাঁ। আমাদের ভাষাটাই এমন। তোমরা না বুঝলে আমাদের কি করার আছে? এসো, আমাদের সাথে থাকো, শিদল পোড়া আর পান্তা ভাত খাও কিছুদিন আর আমাদের মত পরিস্রম করো, তাহলে বছর খানেকের মধ্যে অবশ্যই শিখে ফেলতে পারবে।
যাই হোক। এবার একখানা গল্প বলি। এই গল্পটি আমি আমার বাবার মুখে শুনেছি এবং কম করেও শ’খানেক যায়গায় শুনিয়ে বাহবা কুড়িয়েছি। খুব সুন্দর একটি ছোট্ট উপাক্ষান। বলি, শোনো।
বাংলাদেশের ছোট ছোট গ্রামগুলো সব সুন্দর সুন্দর। গ্রামে গঞ্জে সব্বাই সবাইকে চেনে। গ্রামে সবই আছে – কবিরাজ, মন্দির, মসজিদ, ইস্কুল, হাট, পোস্ট অফিশ আরো কি কি। তবে সব কিছুই খানিক দূরে দূরে। যে সময়ের এই গল্প, সেই সময়ে না ছিল রিক্সা, না ছিল বাস, না ছিল ট্রাম। ছোট বড় সব মানুষই রাস্তা পায়ে হেঁটেই পার হতো। এমনই এক গ্রামে সেদিন ছিল ফল বের হবার দিন – মানে পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে ইস্কুলে। তাই সকাল থেকেই সব বাড়ি ঘরেই পূজা একটু বেশিই হলো। নামাজটাও সেদিন একটু বেশিক্ষনই চললো। ছেলেমেয়ের ফল বেরোবে, সেকি চাট্টিখানি কথা নাকি? হুম...
একটি ছোট্ট ছেলে তার ফল নিয়ে যেই না ক্লাসঘর থেকে বের হয়েছে, অমনি পাশের ক্লাসের রহিম স্যারের সাথে দেখা। অমনি প্রশ্ন এলো, “কিয়ারে, হাঁশ কৈচ্চতনি?” (কি রে পাশ করেছিস নাকি?) রহিম স্যারকে উত্তর দিয়েই সে ছুটে বেড়িয়ে এল, যেন আব্দুল মাস্টার বা নিমাই স্যারের প্রশ্নের সম্মুখিন হতে না হয়। কিন্তু তাতে কি আর রেহাই আছে? আগেই বলা হয়েছে যে গ্রামে সবাই সবাই কে চেনে। নাম না জানলেও এটা কার ছেলে বা কার মেয়ে তা যে কেউ বলে দিতে পারে। তাই যার সাথে দেখা, সেই একবার করে জিগেস করে, “কিয়ারে, হাঁশ কৈচ্চতনি?” ইস্কুল থেকে বাড়ি প্রায় দুই ক্রোশ পথ। পথে যার সাথেই দেখা, তার মুখেই সে এক প্রশ্ন। সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অতিষ্ঠপ্রাণপ্রায় হয়ে সেই ছোট্ট ছেলেটি বাড়ি পৌছয়। বাড়িতে ঢুকতেই বাবার সাথে দেখা হলো। বাবা ছেলেকে কাছে পেয়ে খুশিতে কাছে ডেকে আনেন। আদর করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আশার সাথে জিগেস করলেন, “কিয়ারে, হাঁশ কৈচ্চতনি?”
আর পায় কে? ছোট্ট ছেলেটির মাথা গরম হয়ে যায়, এবং তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এই কথাগুলো –
“হাঁশ কৈচ্চতনি, হাঁশ কৈচ্চতনি। হেতারগো বাড়ির মন্টু হাঁশ কৈচ্চে নি? হেতারা আঁরে হাল্লে টানি ধরি লামাই দেয়, আঁই কোনোমতে রইগেসিগৈ।”
কি, বুঝলে সে কি বলেছিল?
হেহেহে। এই ছিল সেই ছেলের জবাব, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় –
“পাশ করেছিস নাকি, পাশ করেছিস নাকি। ওদের বাড়ির মন্টু পাশ করেছে নাকি? ওরা আমাকে পারলে টেনে ধরে নামিয়ে দেয়, আমি কোনোভাবে রয়ে গেছি।”
মানে ওর পরিক্ষার ফল এমন হয়েছে যে মাস্টারমশায়রা ওকে নিচের ক্লাসে পাঠিয়ে দিতে চাইছিলেন। ও জোর করে নিজের ক্লাসেই রয়ে গেছে। মন্টুও তো পাশ করেনি। তাহলে?
2 মন্তব্য:
ei prothom kono bangla-te lekha blog dekhlam...khub bhaalo laglo...
Golpo shone bhalo laglo....amar ager posting theke syllhet shudhu char ghontar rasta. bangladesh er border e amar postiing chilo.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন